ভালোবাসি ভালোবাসি

রাজ্য

5/9/20251 min read

- রাজন্যা হালদার

(তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেত্রী)

বিষয় যখন রাজনীতি এবং প্রেম, তার মানে ইতিমধ্যেই আমার হাতে লেখার অফুরান উৎসাহ চলে এসেছে। গম্ভীর অথচ ভীষণ প্রাণোচ্ছল এই আলোচনায় আমি কোন পথে এগোব তা বিচার করবে পাঠক। তবে কলমের গতিরেখায় রাজনীতি এবং প্রেমের কথা লিখতে গেলে ঠিক-ভুল সব নিয়েই কিন্তু উপসংহারে পৌঁছোতে হবে। এই সাধারণ বিশ্বাসটুকু এখন কলমের প্রতি আমার জন্মে গিয়েছে। গৌরচন্দ্রিকা না করে যদি একদম রাজনীতির মাঝসাগরে এসে ডুব দিই তাহলে দেখা যাবে এই ময়দানে আমরা সকলেই এক একজন মহারথী। কেউ লড়ছি আবার কেউ বা লড়াচ্ছি। লড়াই ব্যতীত আমাদের অন্য কাজে সেরকম আবেগ আসে কি! এটা প্রশ্নমাত্র। আমি মনে করি এর উত্তর একমাত্র প্রেমই দিতে পারবে। সেই প্রেম হতে পারে রাজনীতির প্রতি আবার রাজনৈতিক মানুষের প্রতি ; দু'টোই সম্ভব।

রাজনীতি আর প্রেমের সরলরেখা এই লড়াইয়ের হাত ধরে কেমন যেন বেঁকে এক বিন্দুতে চলে আসে। লড়তে লড়তে একদিন দেখলাম কখন অনাবিল ভালোবাসায় জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে। আবার রাজনীতির ময়দানে দীর্ঘদিন থাকার পরে একদিন বুঝলাম কেমন যেন 'লড়াকু' তকমা গায়ে লাগিয়ে নিয়ে গৃহকোণে ফিরছি।

তা লড়াই নিয়ে যখন খানিক লিখলাম সহাবস্থান নিয়েও তো লেখা উচিত। রাজনৈতিক সহাবস্থানে প্রেম না থাকলে আমরা কেউই কি গণতান্ত্রিক দেশের এই গণদেবতার সেবায় নিয়োজিত হতাম। একেবারেই নয়। অনেকেই বলবে নেতাদের এসব লোক ভুলানো কথা। লোক কে ভোলানোর জন্যও যে শ্রম লাগে তা কখনোই তাদের পেশাকে না ভালোবাসলে আসবে না। এক্ষেত্রেও সেই ভালোবাসা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বর জীবনে অপরিহার্যই বটে। আবার প্রেমের সমীকরণে খানিক রাজনীতি তো আছে। যেমন ধরুন প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কের মধ্যে হালকা বুদ্ধির বলে মানভঞ্জনের যে চেষ্টা বা সমগ্র পরিবারের একসঙ্গে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার যে প্রয়াস তা মা-দিদিমাদের কথায় মহাভারতের রাজনৈতিক বুদ্ধি থেকেই তো শেখার। সুতরাং আমরা কেউই রাজনীতি বহির্ভূত কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে দিন কাটাই বলে মনে হয় না। প্রেমও কিন্তু সেই অন্তর্ভুক্তির এক প্রক্রিয়া।

জ্ঞানমূলক শিক্ষায় এত ডুবে গিয়েছে যে মনেই নেই আমাকে দেওয়া বিষয়টির মধ্যে নতুন প্রজন্মের অর্থাৎ আমার প্রেমের গল্পও আমি হালকা ঢুকিয়ে দিতে পারি। কিন্তু নিজের প্রেম ও রাজনীতি নিয়ে লেখা শুরু করলে এই পত্রিকার প্রতিটি পাতায় আমার অকারণ অধিকার জন্মাবে। তাই মাঝসাগরে সুনীতা উইলিয়ামসের মতো অবতীর্ণ হয়ে এবার তীরে রওনা দেওয়ার পালা। তীরে যেতে যেতে যতটুকু ভাগ করা যায় তাই শোনাচ্ছি।

প্রেম এবং রাজনীতি আমার কাছে একে অপরের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কলেজ জীবন থেকে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আমার পদার্পণ। ভোটে লড়াই করা থেকে শুরু করে, রাজনৈতিক নানান কর্মকাণ্ডে আমার সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিবারের সঙ্গে কিন্তু আমায় কোনওদিন রাজনীতি করতে হয়নি। পরিবার এক্ষেত্রে বিনা যুদ্ধেই আমাকে সাহস জুগিয়েছে। তবে আমার কলেজ জীবনের একটি ঘটনা আমাকে পরবর্তীতে ভীষণ ভাবিয়েছিল। তখন কলেজ ভোটের ঠিক আগের মুহূর্ত, চারিদিকে যাকে বলে ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে, সবাই সন্ধ্যের অন্ধকারে গোপন মিটিং বসিয়ে একে অপরের ভোটার টেনে নিতে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে আমরা সবাই নমিনেশন জমা দিয়ে ফেলেছি। আমাদের সকলেরই জীবনের প্রথম রাজনৈতিক লড়াই। আমরা তিন জন প্রার্থী দাঁড়িয়েছি একই ক্লাস থেকে। যথারীতি উদ্বেগ চূড়ান্ত। তিন জন মানে কে কত ভোট কাটবে এটাই ভেবে ভেবে আমরা নিজেদের মধ্যে চাপা উত্তেজনায় রয়েছি। তা যাই হোক টানটান উত্তেজনা নিয়ে আমরা পৌঁছালাম সকালে ভোটের দিন কলেজে। অবাক হয়েছিলাম সেদিন এটা দেখে যে আমার সহপাঠী আর দু'জন যারা ভোটে দাঁড়িয়েছিল তাদের মধ্যে মাত্র একজন উপস্থিত হয়েছিল। বামপন্থী মনোভাবসম্পন্ন আমার অপর ওই সহপাঠী সেদিন ভোটের জন্য আসেইনি। এই অবাক করা ঘটনার পরে অনেককে বলতে শুনেছিলাম সেই সহপাঠী আমাকে নাকি ভালোবেসে সেদিন উপস্থিত হয়নি। আমি অবশ্য পরে তাকে মজা করে বলেছিলাম 'ভালবাসলে আসতে পারতিস, বরং এসে আমাকে ভোট দিতিস, নিজের অধিকার নষ্ট করলি কেন?' সত্যি তো আমরা কাউকে ভালোবেসে নিজের অধিকার কেন নষ্ট করব! অধিকার তো গণতান্ত্রিক, অনেক কষ্টে আমাদের পূর্বপুরুষের অর্জন করা। যার সুফল আমরা ভোগ করছি।

এখনও কিন্তু ঠিক তীরে এসে উঠিনি। আর মাত্র কয়েক শব্দ দূরে ওই যে তীর দেখা যাচ্ছে।

এবার আসি জীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। আমার প্রেমের অধ্যায়!

বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আন্দোলন চলছে তৃণমূল ছাত্রপরিষদের। গেটের বাইরে আমাদের সিনিয়র সহযোদ্ধারা ব্যাপক স্লোগান তুলছে। গেটের এই দিকে আমরা মোটে চারজন বাকি সকলে বিরোধী। লড়াইয়ের ময়দানে একটা গেট শুধু অন্তরায়। ভীষণ লড়ছি আমরা চারজন। বাকি তিনজন আমার থেকে একটু ছোট। ওরাও আমার সঙ্গে প্রাণপণে সম্মান বাঁচিয়ে লড়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে সম্মান তো শুধু নিজের নয়, নিজের লোকের, নিজের এই সহোযোদ্ধাদের। ঠিক এই লড়াইয়ের মুহূর্তেই আমার প্রেমের অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটেছিল। স্লোগানে, লড়াইয়ে, সংঘর্ষে কখন জানা নেই আমি, সেই সাহসী রাজন্যা এক ঝটকায় দুর্বল হয়ে গেলাম। তারপর প্রতিদিন রাজনৈতিক মঞ্চ, র‍্যালি, মিটিং, মিছিল করে সেই দুর্বলতা আমাকে বুঝিয়ে দিল এটা রাজনৈতিক প্রেমই বটে। হ্যাঁ আমি এই সম্পর্কের নাম দিয়েছিলাম রাজনৈতিক প্রেম কারণ আমাদের সুখে, দুঃখে, আনন্দে, কান্নায় আমরা ধ্রুব সত্য হয়ে না থাকলেও রাজনীতি থেকেছে। আমাদের রাজনীতির এই ক্ষুধা, এই আকাঙ্খা হয়ত একে অপরের কাছে প্রেমের অধ্যায় তৈরি করেছে। তাই যারা বলে রাজনীতি এবং প্রেম একসঙ্গে হয়ে ওঠে না, রাজনীতির মতো অপবিত্র ভয়াবহ বিভীষিকার সঙ্গে প্রেমের পবিত্রতা যায় না- তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমি একটা অধ্যায় রচনা করে ফেলেছিলাম একদিন।

আমি ইতিমধ্যে তীর দেখতে পেয়ে গেছি। আমাকে তো নেমে যেতে হবে। শুধু একটা কথা বলে যাই- যদিও আমি বলিনি, কবিগুরু বলেছিলেন "গোপনে প্রেম রয় না ঘরে আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে।"

আসলে প্রেম অন্তরালে থাকে না, অন্তরালে থাকলে তা প্রেম হয়ে ওঠে না। তাই তো এত সহজে আমার জীবনের অধ্যায় সবার সামনে তুলে ধরলাম। রাজনীতি এবং প্রেমের মাধুর্য এখানেই, দু'টোই লুকিয়ে রাখা যায় না, একটা অদৃশ্য জেদ সবার সামনে ময়দানে তাকে নিয়ে এসে ফেলবেই।

প্রেম এবং রাজনীতির সমান্তরালের যাত্রা এখানে শেষ হল। আমিও অবশেষে স্মৃতিবিজড়িত হয়ে তীরে এসে উঠলাম। ভালোবাসার হাত ধরে কাঙাল হয়ে যদি কোনওদিন রাজনীতির সামনে এসে দাঁড়াই, আমার বিশ্বাস রাজনীতি আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে না। এটাই রাজনীতির ভালোবাসা।

(অন্য কলম)